"শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীনকালের গুরুগৃহ- বাসের মতো সমস্ত নিয়ম। বিলাসিতার নাম গন্ধ থাকিবে না- ধনী দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্য্যে দীক্ষিত হতে হইবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯০১ সালে আগস্ট মাসে বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন তাঁর এই ইচ্ছের কথা আর শান্তিনিকেতনে ‘পাঠভবন’ নামক যে স্কুলটির সাথে আজ আমরা সকলেই পরিচিত, তার প্রাতিষ্ঠানিক জন্মও ১৯০১ সালেই, যদিও তখন ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ নামেই ছিলো তার পরিচিতি। সনাতন ভাবধারায় প্রাণিত চিত্ত তাঁর, প্রাচীন তপোবনের আদর্শকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এই ব্রহ্মবিদ্যালয়ের মননে। মনের সেই ডাকে সাড়া দিয়েই তাই প্রকৃতি ও পরিবেশের সাহচর্যে সহজ সরল উপকরণ বাহুল্য বর্জিত জীবন, সহযোগিতার সৃজনশীল নীতি এবং শিক্ষক- ছাত্র নিবিড় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পোক্ত করতে চেয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের ভিত। ভারতবর্ষের বিকল্প আধুনিক শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎও বলা যায় এই বিদ্যালয়টিকে। যুক্তিবাদী, উদারমনস্ক ইউরোপীয় শিক্ষানীতিকে বর্জন করে নয়, বরং তাকে স্বীকার করেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন আড়ম্বরহীন, গুরু-শিষ্য সম্পর্ককেন্দ্রিক এক ব্রহ্মচর্যভিত্তিক শিক্ষাধারাকে। তিনি ধর্মের যাবতীয় গোঁড়ামিমুক্ত, যুক্তিবাদী মন তৈরিতে যেমন তৎপর ছিলেন, তেমনই সে মননে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ব্রহ্মচর্য, ত্যাগ, অনাড়ম্বতা, যাপনের সহজতার মত বিভিন্ন প্রবৃত্তিকেও। ইউরোপীয় বিদ্যাকে নয়, বর্জন করেছিলেন সেই বিদ্যা সংক্রান্ত যাবতীয় যান্ত্রিকতাকে। বিদ্যালয় শুরু হয়েছিলো মাত্র পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে।
বর্তমানে পাঠভবনে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। সম্পূর্ণ আশ্রমিক ভাবনায় প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে অবশ্য বর্তমানে আবাসিকদের সাথে সাথে অনাবাসিক ছেলেমেয়েরাও পাঠরত। হস্টেল এবং বাড়ির ছেলেমেয়েদের সহবস্থান ঘটেছে এই স্কুলে, সকলেই এই বিদ্যালয়েরই অঙ্গ। আশ্রমিক জীবনচর্যায় শিক্ষক ও ছাত্রের একত্রে যাপনের ইচ্ছায় সেকালে গুরুশিষ্য একসাথেই থাকতেন, খেতেন এবং জীবন যাপন করতেন। এখন অবশ্য পরিস্থিতি এবং বাস্তবিকতার চাপে তা অনেকখানিই ক্ষুণ্ণ তবে বিলুপ্ত নয়। সময়, সুযোগ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী পাশাপাশি এখনো বসে পড়ি শিক্ষক আর কচিকাঁচার দল, পাশাপাশি হৈ হৈ করে, তা সে বার্ষিক বনভোজনই হোক বা হস্টেল পিকনিক বা পিঠেপার্বণ উৎসব—খাওয়া আর গল্প চলতে থাকে একসাথেই। এর মধ্যে দিয়েই প্রস্ফুটিত হয় সহযোগী সহবস্থানের কল্পিত চিত্ররূপ।
সকাল সকাল ঘন্টাতলায় বৈতালিকের ঘন্টা বাজায় ছেলের দল, পড়ুয়ারা সমবেত হয় একে একে, দিন শুরু হয় মন্ত্রপাঠ আর গান দিয়ে। তারপরেই ক্লাসের ঘন্টা এবং ছেলেমেয়ের দল হাজির হয় যে যার ক্লাসে, গাছতলায়, বেদীতে। গাছতলায় বসে ক্লাস করা— পাঠভবনের শিক্ষাব্যবস্থার এ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রবির পাঠশালায় তাই গাছতলাতেই বসে ক্লাস, সকলে আসন পেতে সেই ক্লাসে গোল হয়ে বসা। কেউ কারো সামনে না, কেউ কারো পিছনেও না, সকলেই দেখবে সকলের মুখ, আর মাস্টারমশাই বসবেন সেই বৃত্তের ওপারে সবার মুখোমুখি বেদীতে অথবা মাটিতে। এই বসার পদ্ধতিটি আসলে ইংরিজি শিক্ষাব্যবস্থার সেই ‘ক্লাসরুম’ সংক্রান্ত ধারণার মূলটিকেই অস্বীকার করা। পাঠের আদান প্রদানের সাথে প্রকৃতির নিবিড় যোগস্থাপনের এর থেকে ভালো উপায় আর কিছু পাননি রবীন্দ্রনাথ— আমরাও পাই না। ঋতু বদলের সাথে সাথে প্রকৃতির বদলের রঙ, রূপ, গন্ধ গায়ে মেখে নিতে নিতে তাদের বড় হয়ে ওঠা, হঠাৎ করেই একদিন ফাঁকা ডালকে ফুলে ফুলে ভরে উঠতে দেখার বিস্ময় কাটিয়ে প্রকৃতির যাবতীয় রহস্যের সারবত্তা আবিষ্কার ও উদ্ধার করতে পারার মধ্যে দিয়ে যে পথ সে পেরিয়ে যায়, তাতেই তার মধ্যে জাগ্রত হয় জীবনের সার্বিক বোধ, পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার শক্তি অর্জন করে সে। প্রকৃতির সাথে লেনদেনের এই সংযোগে বিষয়ভিত্তিক পড়াশুনা আর জীবনের উপাদানের অবিচ্ছিন্নতার বোধসঞ্চার হয় শিক্ষার্থীর মধ্যে। তাই শুধু প্রকৃতিপাঠের ক্লাসেই নয়, প্রত্যেকটি ক্লাসেই অদ্ভুতভাবে প্রকৃতি এবং বিষয়ের বক্তব্যের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে চলেন শিক্ষককুল, প্রতি মুহূর্তে।
পাঠভবনের শিক্ষা ও শিক্ষণের একটা বড় দিক হচ্ছে শিক্ষার্থীর মধ্যে বিষয়গত পড়াশুনা, কাজকর্ম এবং সেই সংক্রান্ত ভাবনা চিন্তার উত্তরণের সাথে সাথে জীবনবোধ ও দর্শনের উত্তরণ ঘটানো। শিক্ষণপ্রণালী এ ক্ষেত্রে সন্দেহাতীত কৃতিত্বের দাবি রাখে। মুখস্থ প্রণালী বর্জিত শিক্ষণ পদ্ধতিতে কথোপকথনের মাধ্যমে, হাতেকলমে প্রমাণ সাপেক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে, তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে চলতে থাকে বিষয়ভিত্তিক পাঠদান। কবিতার বা গল্পের একটি সূত্র বা ছত্র ধরিয়ে দিয়ে তাকে ছেলেমেয়েদের দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, প্রকৃতিপাঠের ক্লাসের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানকে চিনতে শেখা,
বুঝতে শেখা এসব কিছুরই ধারা কবির সময় থেকে আজও চলে আসছে নিজ স্রোতে। আঁকার ক্লাসে বস্তুর সামনে বসে তাকে পর্যবেক্ষণ করা এবং রেখায়, রঙে আপন দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকে ফুটিয়ে তোলা, প্রকৃতি থেকেই ছবির রসদ সংগ্রহ করা, সে তো আজও স্ব-মহিমায় বিদ্যমান। গান, নাচ বা হাতের কাজের ক্লাসের মধ্যে দিয়ে তাদের মধ্যে সামগ্রিকতার বোধ জাগ্রত হয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তার অধিকারী হয়ে ওঠে তারা, অচিরেই। এসব কিছু ছাড়াও আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক কিন্তু রয়ে যায়। সিলেবাস ভিত্তিক বিভিন্ন পাঠদানের মধ্যে দিয়েই চলতে থাকে সেই সংক্রান্ত জীবনবিষয়ক বোধের পাঠদান, চলতে থাকে প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে যোগসূত্র তৈরীর প্রচেষ্টা। একক, আলাদা কেউ না, সকলেই জড়িত এখানে;
” বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।।”
‘আশ্রম সম্মিলনী’ পাঠভবনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, পড়াশুনার পাশাপাশি পাঠভবনের আশ্রমিক জীবনে রয়েছে এর একটি সমান্তরাল প্রবাহ। কবি এই আশ্রম সম্মিলনীর মধ্য দিয়ে আসলে ছেলেমেয়েদের স্ব-নির্ভর করতে চেয়েছিলেন। সুষ্ঠভাবে আশ্রম চত্ত্বরের দেখাশুনা, আশ্রমের যাবতীয় কার্যপদ্ধতি নির্বাহ এই সমস্তই ছেলেমেয়েরা নিজেরাই করুক এমনটিই ছিলো তার ইচ্ছা। এই পথ চলার মধ্য দিয়েই তাদের ভিতর জাগ্রত হবে তাদের সম্পূর্ণ সত্তা, এমনটাই তিনি মনে করেছিলেন। স্থানে স্থানে, খোলা আকাশের নীচে দিনক্ষণ ঠিক করে মাস্টারমশাই ও ছাত্রছাত্রীর দল বসে পড়তো, অনাড়ম্বরভাবে অনুষ্ঠিত হত সাহিত্যসভা। স্বরচিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ পাঠ করতো ছেলেমেয়েরা; হতো নাচ, গান। আজও সেই ধারা অক্ষুণ্ণ ও অব্যাহত। সময়ের প্রকোপে তা শুধু আকারে বড় হয়েছে মাত্র। সাহিত্যসভা ছাড়াও আশ্রম -সম্মিলনী থেকে ছেলেমেয়েরা আয়োজন করে বসন্ত আবাহন, পিঠেপার্বণ উৎসব, দানসংগ্রহ, বর্ষা বা বসন্তের কবিতাপাঠের আসর, বিভিন্ন রকমের আলোচনা সভা, বিতর্কসভা এমন আরো কত কী! এই সমস্ত কিছু আয়োজনের সমস্ত দায়ভার তারাই গ্রহণ করে এবং একে সুষ্ঠভাবে পরিচালনাও করে নিজেরাই। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকরা শুধু তাদের সাহায্য করে থাকেন ক্ষেত্র বিশেষে। এই ভাবেই ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে জাগ্রত হতে থাকে সৃজনসত্তা, পরিচালন ক্ষমতা— ক্রমেই অগ্রসর হয় স্বয়ং-সম্পূর্ণতার অভিমুখে।
এ ছাড়াও রয়েছে পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বৃক্ষরোপণ, বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব এসব অনুষ্ঠান পালন এবং এর যাপন। প্রতিটি ঋতুর উদযাপন যে পাঠভবনের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তাতে কোনও সন্দেহ নেই! ছেলেমেয়েরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে; হয় গান, নাচ, পাঠ, নাটক এবং নৃত্যনাট্য। নিয়মিত মহড়ায় অংশগ্রহণ এবং একে অপরের সাথে সেই সংক্রান্ত অনুভূতির ভাগাভাগি, এসব আসলে তাদের মধ্যে সহানুভূতিশীলতা, নিয়মানুবর্তিতা, পারস্পরিক সহযোগিতার এক সম্মিলিত বোধ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে তাদের সারা জীবনের সম্পদ হিসাবে ব্যাপ্তিলাভ করে।
তাই রবির এই পাঠশালাটি শুধুই এক বিদ্যালয় মাত্র নয়, এ আসলে এক সম্পূর্ণ জীবনবোধ, এক পরিপূর্ণ জীবনদর্শন। এর মধ্য দিয়ে সংঘটিত শিক্ষা-শিক্ষণের এই পদ্ধতিটি আসলে ত্রিমাত্রিক। পড়ুয়া, মাস্টারমশাই আর প্রকৃতি, এরা সকলেই একে অপরের পরিপূরক। সকলেই শিক্ষার্থী, সকলেই শিক্ষক। তাই “আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।”
ছবি : নম্রতা ভট্টাচার্য ও সৈকত দাস