বাংলার মফস্বল বলতে কলকাতার বাইরে যে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড পড়ে থাকে জেলায় জেলায়, তার সবটাকেই বোঝায়। মফস্বলে রবীন্দ্রচর্চা একটা বিশাল পরিসরের ব্যাপার যা দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। আমি আমার সীমিত পড়াশোনার মাধ্যমে শুধু বীরভূম জেলাতে কিছুটা অনুসন্ধান করতে পারি মাত্র। সেটাই ধরবার চেষ্টা করছি এই লেখায়।
রবীন্দ্র শতবর্ষ থেকেই অর্থাৎ ১৯৬০ সাল আসার পরেই রবীন্দ্রচর্চার ব্যাপক জোয়ার এসেছিল কলকাতায় এবং তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। আমার আলোচনা যদিও বীরভূমের গ্রাম ও শহর কেন্দ্রিক তা সত্ত্বেও শান্তিনিকেতনকে আমি আলোচনার বাইরে রাখছি কারণ সেটা নিয়েই আলাদা একটা লেখা তৈরি করা যায়।
বীরভূমের তথাকথিত উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতিচর্চা অর্থাৎ নাটক গান আবৃত্তি ইত্যাদির প্রসার ব্যাপকভাবে মাথা তুলেছিল সাতের দশকে। এই সময়েই অজস্র নাট্যদল এই জেলায় গড়ে ওঠে, প্রকাশিত হতে থাকে অগণন লিটল ম্যাগাজিন। বীরভূমের সংস্কৃতি চর্চার চেহারাটা ঠিক কেমন ছিল তার ওপরে প্রথম আলোকপাত করা যাক এবং তারপর দেখা যাবে সেই আলো রবীন্দ্রচর্চাতে পতিত হল কবে কখন ও কীভাবে। সংস্কৃতিচর্চা মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত চিরকালই তিন ধরনের অবয়ব নিয়ে। বীরভূমও তার বাইরে ছিল না। প্রথমত অন্তজ শ্রেনি, যাদের সংস্কৃতিতে বাউল কেষ্টযাত্রা বোলান হাপু কবিগান যাত্রা-সহ বিনোদনের মধ্যে ছিল বারো মাসে তেরো পার্বনে গাজন ধরমপুজো মনসার ভাসান থেকে নানান মেয়েলি ব্রতর নিগড়ে বাঁধা। রবীন্দ্রনাথ সেখানে কোনোদিনই প্রবেশ করতে পারেননি এবং এখনও তিনি অপরিচিতই আছেন। যতই তিনি বলুন না কেন মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক সেটা হয়নি আজও।
দ্বিতীয়ত, ধনী সম্প্রদায়ের যে সংস্কৃতি কলকাতা বা উন্নত শহরে লক্ষ্য করা যায় অর্থাৎ ক্লাব কালচার, নৈশক্লাবের নাচাগানা খানাপিনা প্রভৃতির ছিটেফোটাও বীরভূমে নেই ও ছিল না। এখানকার অভিজাত সম্প্রদায়ের একটা বিরাট অংশ রাজস্থানী মারওয়ারি বংশীয় যারা জৈন ধর্মাবলম্বী এবং তাদের সংস্কৃতি চর্চা ছিল নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে জৈন মন্দির বা কোনও ধনীর বাসগৃহে নাম গান ও আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাকি ধনীসম্প্রদায় বাড়িতে দোল দুর্গোৎসব করেছেন, সেখানে বাঈনাচ থেকে খেমটা নাচ সবই হয়েছে। লোকসংস্কৃতির বিপুল লোক দেখানো আড়ম্বর তারাও করেছেন এবং লোকসাধারণ সেইসব ধনী ও জমিদারের উঠোনে রাত জেগে বাউল কবি গান যাত্রা শুনে এসে ধন্য ধন্য করেছে চিরকাল। মোটকথা, তাদের সংস্কৃতি ছিল আপন অর্থের গরিমা সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষনা করা।
হাতে রইল মুষ্টিমেয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অতি সামান্য অংশ যারা রবীন্দ্রচর্চায় নিযুক্ত এবং সেই চর্চাও মূলত রবি ঠাকুরের গান। বাঙালি মধ্যবিত্তের বাড়িতে কন্যা থাকলেই একটি হারমোনিয়াম থাকে। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এলে কন্যা যাতে অন্তত সা পা ধরে হলেও ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ অথবা ‘আগুনের পরশমণি’ গাইতে পারে তার প্রাণান্তকর চেষ্টা। এই সূত্রেই কিছু সঙ্গীত শিক্ষক বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোনোরকমে নিজের সংসারের জোয়ালটা টেনে নিয়ে গেলেন গুরুদেবের কৃপায়। এদেরই খুব সামান্য একটা অংশ রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করলেন সারা জীবন এবং এখনও করে চলেছেন। রবীন্দ্রচর্চার এই সঙ্গীত অংশটি তো তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সিকিভাগ মাত্র। তাঁর নাটক? খোদ কলকাতাতেই রবীন্দ্রনাথের নাটক দীর্ঘকাল কল্কে পায়নি তো মফস্বল। শ্যামবাজারি বাণিজ্যিক থিয়েটার রবি ঠাকুরকে নিয়ে কাজ করেনি বললেই চলে। শিশিরকুমার দু-একটি নাটক করলেও একা বহুরূপী ছাড়া রবীন্দ্র নাটক নিয়ে কাজ করা নাট্যদল হাতে গোনা যাবে। রবীন্দ্র শতবর্ষে এসে এবং অতিসম্প্রতি দেড়শো বছরে কিছু রবীন্দ্র প্রযোজনা লক্ষ্য করা গেলেও তার কতটা ভিতরের তাগিদ থেকে আর কতটাই বা অনুদানের দিকে তাকিয়ে তা তর্কসাপেক্ষ।
বীরভূমের গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলি এখন মাছি তাড়ালেও যখন পাঠক সমাবেশে গমগম করত তখনও কোন লাইব্রেরীতে কখানা রবীন্দ্রগ্রন্থ আছে এবং এযাবৎকাল তার কতগুলো ইস্যু করা হয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করলে ডক্টরেট পেতে পারেন আগ্রহী পাঠক। কিছু গ্রন্থাগারে রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকলেও তাকে কাচের আলমারিতে তালাবদ্ধ অবস্থায় জাদুঘরের স্টাফ করা মৃত জীবজন্তুর মতো রাখা হয়। পাঠক চাইলেও কর্তৃপক্ষ দিতে কিন্তু কিন্তু করেন। বহু বহু সমীক্ষা করে দেখা গেছে উচ্চশিক্ষিত বাঙালিকে রবীন্দ্র উপন্যাসের নাম জানতে চাইলে তারা বলেছেন চোখের বালি এবং ঘরে-বাইরের কথা কারণ ওই দুটি চলচ্চিত্রে বহুচর্চিত। শরৎসাহিত্য বললে যেমন দেবদাসের নাম উঠে আসে ।
বরং বলা চলে সারা বাংলার মতোই বীরভূমের রবীন্দ্রচর্চা ‘বছরে পঁচিশবার চিত্রাঙ্গদা আর শ্যামা শাপমোচনের অশ্রুমোচন।’ বালিকা বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনৃত্যের ও গীতিনাট্যের একটা আবহমান চর্চা আছে একথা স্বীকার করাই ভালো।
তার আঁকা ছবি বা প্রবন্ধ বিষয়ে আলোচনা না করাই ভালো সুতরাং এই প্রবন্ধ কোনও ইতিবাচক আশা জাগাতে পারছে না। শান্তিনিকেতনের লাগোয়া গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখুন সেখানেও এখনও এসে পৌঁছায়নি ‘রবির কর।’ রবীন্দ্রনাথ আজও আমজনতার নন, তিনি শিক্ষিত মিডিল ক্লাসেরও যারা কুলিন সেই এলিটবৃত্তে বিরাজমান। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে এবং চিরকাল থাকে কিন্তু তারা নগণ্য মাত্র। ফলত রবি ঠাকুরের কথা জানতে চাইলে উঠে আসে সেই অনিবার্য রসিকতা— রবি ঠাকুরের কথা বলতে পারব না, শনি ঠাকুর লাগলে বলবেন অনেক আছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে।