এক একটা লেখা লিখতে বসে এত মুশকিলে পড়ি, এতখানি অসহায় মনে হয় নিজেকে যে আমি যে আদৌ কিছু গুছিয়ে লিখতে পারি সে বিশ্বাসের ভিতেও ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। আর কোথাও প্রকাশ করার জন্য কিছু লিখতে আমার বরাবরের সংকোচ। এই কারণে যে মনে হয় গণ্ডিতে আটকে গেলাম। আমার পত্রিকায় যখন নিয়মিত লিখতাম যা খুশি লিখতাম কারণ আমিই সম্পাদক। ফেসবুকে লিখি কারণ সেই একই। আমিই সম্পাদক। কোথাও ‘বার’ হবে-তে অল্পবয়সেও আগ্রহ ছিল না। এখন তো একেবারেই নেই।
এই লেখা আমার একটা সিটিং-এ হয়ে যাবার কথা। বানান ভুল সহ। কিন্তু এটা আমার লেখার তিন নম্বর প্রয়াস। তিনটে তিন সময়ের কথা মনে পড়ল এই লেখার প্রাকভাষ লিখতে বসে।
বছর বত্রিশ আগে একটা মঞ্চনাটক লিখেছিলাম ‘আমরা সবাই রাজা’। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা ও গান থেকে বেছে নেওয়া কয়েকটি শিশু চরিত্র নিয়ে। সেই নাটকের শেষ দৃশ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথ বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন আর খোকা তাঁকে জিজ্ঞেস করছে— গুরুদেব, তুমি শান্তিনিকেতনে যাচ্ছ? এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলছেন: না, ওই জায়গাটা আর আমার ভালো লাগে না। ওখানে এখন কী যে সব হচ্ছে আমি আর বুঝতে পারি না। এই নাটকের প্রথম অভিনয় তারাবাগে হয়েছিল। সেখানকার কিছু শান্তিনিকেতনের গন্ধমাখা অধ্যাপক/অধ্যাপিকা মৃদু আপত্তি করেছিলেন। এই নাটকটি পরবর্তীতে সারা শহরে নানা জায়গায় অভিনীত হয়। এই নাটকের বক্তব্যে আমি এখনও স্থিত।
দ্বিতীয় ছবিটাও বছর তিরিশ আগেকার। সারা শহর তথা পশ্চিমবাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে শোভা পেত একটি পোস্টার । রবীন্দ্রনাথের মুখের বড়ো একটি রঙিন ফটো। নীচে লেখা: আমি তোমাদেরই লোক। তার নীচে তৎকালীন প্রধান শাসক দলের নাম বড়ো করে লেখা। এই এতখানি রবীন্দ্র প্রেমের পিছনে প্রধান প্রণোদনা ছিল ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ এই উক্তিটির রাজনীতিকরণ। ‘সহজপাঠ’-এর জয়জয়কার। কেউ উল্লেখও করলেন না— কোনও ছোটো-বড়ো-মাঝারি-দেশজ-আন্তর্জাতিক–লাল-সবুজ-গেরুয়া-কমলা— কোনও প্রকারের বুদ্ধিজীবীই— যে রবীন্দ্রনাথ পাশাপাশি যত্ন সহকারে ইংরাজি শেখাতেও বলেছেন এবং শুধু তাই নয় কীভাবে কী পদ্ধতিতে পড়াতে হবে তাও লিখে গেছেন বিস্তারিত ভাবে তিনটি বইতে।
তৃতীয় সময়ের অভিঘাত সমসময়ের। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘ইংরেজি সহজ শিক্ষা’— প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ এবং ‘ইংরেজি শ্রুতি শিক্ষা’ পাঠভবনেও পড়ানো হয় না। অনেক বছর ধরেই। কেন তা আমার মত অর্বাচীন ও অবুদ্ধিজীবী বলতে পারব না।
এবার আমার কথায় আসি। আমার পরিচয় এই যে আমি নানাস্তরে পঠপাঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম, যদিও আমার প্রিয় ঠিকানা কেজি স্কুল— যেখানে ৩+ বয়স থেকে ৮+/৯+ বয়সী ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে আসত। এ ছাড়াও আমি ব্যক্তিগত স্তরে বারো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে ইংরাজি বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করি। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমি প্রধানত বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের ইংরাজি-ভীতি দূর করার কাজে নিযুক্ত থাকি। এবং কীভাবে এই ভয় ভাঙানো যায় সে পদ্ধতির খোঁজ খবর সংগ্রহ করে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করি। একজন মাস্টারমশাই যদি তার কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান না হন, একজন ছাত্র বা ছাত্রীর মতোই বা তার থেকেও বেশি পড়াশোনা না করেন নিয়মিত, তাহলে তিনি খুব একটা কাজে লাগবেন না ছাত্রছাত্রীদের। আমার অভিজ্ঞতা এরকম। ফলে নানা সূত্র ধরে এবং অভিজ্ঞ শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের কাছ থেকে শিখতে চেষ্টা করি। এর পিছনে কারণ এই যে ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যে সামান্য অনুরাগ থাকলেও আমার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দলিলদস্তাবেজ— গ্রামে বলে কাগজ— নেই। ফলে ভয়ে ভয়েই থাকি— এই বুঝি কেউ— কাগজওয়ালা— ভুল ধরল। সমস্যার অন্ত নেই গরীব মানুষের।
আর একটি প্রণোদনাও কাজ করেছে। আমাদের পুত্র যখন স্কুলে পড়ার বয়সী হতে চলেছে এবং আমাদের সিদ্ধান্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর, তাকে ইংরেজি শেখানোর তাগিদটাও ছিল। বাংলায় বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথ আলো দেখালেন। মনে হল এই মানুষটা একাশি বছর ইংরেজ আমলে বিচরণ করেছেন। শান্তিনিকেতনে তিনি বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের মানুষকে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তিনি নিশ্চয়ই ইংরেজি শেখানোর কথাও ভেবেছেন। এভাবেই হাতে আসে এক অমূল্য সম্পদ— আমাদের উত্তরাধিকার— তাঁর তিনখানি ছোটো বই। এই বইগুলি শিক্ষক/শিক্ষিকাদের জন্য— কীভাবে একজন প্রথম প্রজন্মের গ্রামের ছেলেকে ইংরাজি শেখাতে হবে। আমরা পড়লাম। আমরা পড়লাম এবং মুগ্ধ হলাম। এই ‘আমাদের’ মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরাজি পঠনপাঠনের সাথে যুক্ত। আমরা বেছে নিলাম ‘ইংরেজি সহজ শিক্ষা’। ভিত গঠনের কাজ এই বই তিনটির হাত ধরেই। পরবর্তীতে আমাদের পুত্র এইচ সি ইউ (হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ইংরাজিতে মাস্টার্স করেছে এবং বছর দুই সিফেলে গবেষণা করেছে(বর্তমানে EFLU, তখন এই নাম ছিল)। এইটুকু ব্যক্তিগত কথা বলার কারণ আমাদের পুত্রের এবং আমার বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ইংরাজিতে দক্ষতা জন্মেছে ‘সহজে ইংরেজি শিক্ষা’–র ভিতের উপর দাঁড়িয়ে।
আধুনিক কালের মাস্টারমশাই ও দিদিমণিরা চমস্কি থেকে শুরু করে অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের কথা বলেন এবং বড়ো কঠিন কঠিন সব তত্ত্বের কথা বলেন। তোতাকাহিনীর গল্পের সেই তোতাটির করুণ দশা ঘটে এর ফলে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের। কি না আধুনিক পদ্ধতিতে ভাষা শেখাতে হবে। ওসব ট্রান্সস্লেশন পদ্ধতি ও গ্রামারের হাত ধরে ইংরেজি শেখানো সেই মান্ধাতার আমলের ঠাকুমার ঝুলির সময়কার পদ্ধতি। পৃথিবীর কোনও সভ্যদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি আর গ্রাহ্য নয়। আমি একেবারে সহমত এঁদের সঙ্গে। শুধু দুটো আপত্তি জানিয়ে রাখি। ‘পৃথিবীর’ খবর রাখতে গিয়ে এরা এদেশের গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের তত্ত্বতালাশ করতে ভুলে গেছেন। দ্বিতীয়ত এরা রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি শেখানোর একটা বইয়েরও পাতা উল্টে দেখেননি। মনে রাখেননি যে মানুষটার জন্ম সিপাহী বিদ্রোহের তিন বছর পরে এবং তাঁর প্রায় সবটুকু জীবন-যাপন-কাল মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমলেই। এদেশে ইংরেজ শাসনের দ্বিতীয় অধ্যায় পর্বে। এই মানুষটি পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিভাধর মানুষজনের সাথে মত বিনিময় করবেন এবং এক সময়ে কলকাতার কোলাহল ও চাকচিক্য থেকে অনেক দূরে শান্তিনিকেতনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করবেন যেটি এককালে প্রকৃত অর্থেই ‘বিশ্ব’বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হবে— তিনি জানতেন না গ্রামের সাধারণ ঘরের ছেলেদের— যারা প্রথম প্রজন্মের ছাত্র— তাদের কীভাবে ইংরেজি-ভীতি দূর করে ইংরেজি শেখানো যায়? ‘ইংরেজি সহজ শিক্ষার’ ভূমিকা উদ্ধৃত করছি ( আজ থেকে ১১১ বছর আগে প্রকাশিত):
মুখস্থ করাইয়া শিক্ষা দেওয়া এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। শব্দ ও বাক্যগুলি নানাপ্রকারে বারবার ব্যবহারের দ্বারা ছাত্রদের শিক্ষা অগ্রসর হইতে থাকিবে, ইহাই লেখকের অভিপ্রায়। শব্দগুলি বোর্ডে লিখিত থাকিবে, ছাত্ররা তাহাই দেখিয়া মুখে ও লেখায় বাক্যরচনা অভ্যাস করিবে।এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট-ভাগে অনেকগুলি বিশেষ্য বিশেষণ শব্দ দেওয়া হইয়াছে, সর্বদা ব্যবহার্য শব্দ-শিক্ষায় ও বাক্য-রচনা-চর্চায় সেগুলি কাজে লাগিবে। যে রীতি অনুসরণ করিয়া লেখক একদা কোনো ছাত্রকে অল্পকালের মধ্যে অনেকটা পরিমাণে অনেকটা পরিমাণে ইংরেজি শিখাইতে পারিয়াছিলেন এই গ্রন্থে সেই রীতি অবলম্বন করা হইয়াছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দুটো গুরুত্বপূর্ণ কথার প্রতি আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথমত এই বইটি যারা ইংরাজি শেখাবেন তাঁদের জন্য। দ্বিতীয়ত রবীন্দ্রনাথ প্রথমে হাতে কলমে তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাঞ্ছিত ফল লাভ করার পর তবেই এই বই লেখার কথা ভেবেছেন।
এই বইয়ের কোথাও— আমি তিনটি বইয়ের কথাই বলছি— গ্রামার শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। প্রথমে দুটি শব্দ, তারপর এক সময় তিনটি শব্দ, তারপর আরও একটি অতিরিক্ত বিশেষণ পদ এবং তারপর প্রায় অজান্তেই ‘Be’, ‘Have’ and ‘Do’ verb এর ব্যবহার । বাক্য রচনা এইভাবে— The boy- The bad boy- The bad fat boy- The bad boy is fat- Is the fat boy bad?- Is the fat boy not bad?- Yes, the bad boy is fat. Or, No the fat boy is not bad, he is good. এইভাবে কী অনায়াস সহজতায় ছেলেরা (ছেলেমেয়েরা) ইংরেজি বাক্য রচনা শিখে যাচ্ছে গ্রামার শব্দটির উল্লেখমাত্র না করেই। এইভাবে by natural progression তিনি আমাদের শেখাচ্ছেন common preposition and tenses এর প্রয়োগ। বাংলা থেকে ইংরাজি এবং ইংরাজি থেকে বাংলা প্রতিটি অধ্যায়ের অঙ্গ। ‘ইংরেজি শ্রুতি শিক্ষা’র ভূমিকায় বিস্তারিত ভাবে তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে এই ভাষা শুনতে হবে এবং বলতে হবে। আধুনিক পদ্ধতি নয়? মান্ধাতার আমলের কথা? এখন অলিতেগলিতে আগাছার জঙ্গলের মত Spoken English শেখানোর নানা ফ্যাশন দুরস্ত প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। রবীন্দ্রনাথ এই বইয়ের ভূমিকায় যা বলাছিলেন তার প্রথম দুটি বাক্য উদ্ধৃত করি:
ইংরেজি-শিক্ষার্থী বালকেরা যখন অক্ষর-পরিচয়ে প্রবৃত্ত আছে সেই সময়ে কেবল কানে শুনাইয়া ও মুখে বলাইয়া তাহাদিগকে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত করিবার জন্য এই গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। এই শ্রুতিশিক্ষা শেষ করিলে বই পড়িবার অবস্থায় বালকদের অধ্যয়ন-কার্য অনেক সহজ হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।
রবীন্দ্রনাথ দাবি করেননি যে এই পদ্ধতিই একমাত্র পদ্ধতি ইংরেজি শেখানোর। কিন্তু আমার প্রশ্ন একটাই ২০২০ সালেও কি এর থেকে ভালো কোনও পদ্ধতির উদ্ভব কেউ করেছেন? আজকের যুগের সাথে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার একটাই মূল পার্থক্য নজরে পড়ে। তিনি human resource অর্থাৎ মানব সম্পদের উপর জোর দিয়েছিলেন। শিক্ষক ও ছাত্র। পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা খুব জরুরি। আর এখন এই ডিজিটাল যুগে যন্ত্রই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে— আজকের পরিভাষায় social distancing of students and teachers. এর বিষময় ফল কী হতে পারে তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি প্রতিদিন। শ্রদ্ধা ভালোবাসা মানবিকতা সৌজন্যবোধ— এসব আর গুণাবলী বলে বিবেচিত হয় না।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে— আমাদের অমূল্য উত্তরাধিকারের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। এখন ঘরে ফেরার সময়। রবীন্দ্রভাবনা ও বোধের আবহে ফেরার সময়।