ঘরের চেয়ে বারান্দার খোলামেলাই আমার বেশি পছন্দ। ছোটো থেকেই হস্টেলে যেচে যেচে জানলার ধারে খাট নিতাম। এইগুলোই আমার নিভৃতচারণ। একেবারে ছোটোবেলায় আর পাঁচটা সাধারণের মতোই স্কুলে যেতাম— মুরগীর খাঁচার মতো ভ্যানে, টিনের বাক্স নিয়ে। তারপর ঘষে মেজে অনেকবার চেষ্টা করে পাঠভবনে ভর্তি হই। তারপর বড়ো হয়ে ওঠার পুরো সময় জুড়েই শান্তিনিকেতন।
এই… এইমাত্র পুলিশের গাড়ির পিছু পিছু সশ্রদ্ধায় রবীন্দ্রনাথ হোর্ডিং ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে গান শোনাতে শোনাতে চলে গেল… সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি। বিশ্বাস করুন, এক বর্ণ বানিয়ে লিখছি না। সেই নানারঙের দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথকে জানার ব্যাপারে জোরজার কি কম ছিল! টর্চারের অপর নাম ছিল রবীন্দ্রসপ্তাহে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বক্তৃতা, নাইন-টেনে প্রথম প্রথম শাড়ি পড়ে উপাসনা মন্দিরে সক্কাল সক্কাল যাওয়া। আছে আছে আরও আছে। কিন্তু জীবনের মাত্র ১২-১৩ টা বছর শান্তিনিকেতনে কাটাতে কাটাতে কখন যে এগুলো অভ্যাস আর বিরক্তির বদলে ভালোবাসা-স্মৃতি আর পুরো মেয়েবেলাটা হয়ে গেছিল জানতে পারিনি।
এখন আমার মতাদর্শের জল অনেক দূর গড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আমার মতাদর্শ নয় কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমি ছাড়তে পারব না। প্রয়োজনও বোধ করি না (এটা এঁড়ে তার্কিকদের জন্য)। যত বড়ো হয়ে উঠছিলাম পাঠভবন শেখাতে শেখাতে যাচ্ছিল। যেভাবে চলতে ফিরতে পাতাবাদাম কুড়োতাম ততটাই সহজে। ‘কিছু করা’, ‘একসাথে কিছু করা’— এই, এইখান থেকেই আজকের আমি জন্মেছি। আশ্রম সম্মিলনীর ধারণা আজও আমাকে অভিভূত করে। সময়ের চেয়ে আজও কোথাও কোথাও রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে। একটা বিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। ভোট হবে। ভোট চাওয়ার নানা স্ট্র্যাটেজি থাকবে। চকলেট খাইয়ে আর প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখানোর ভয়ানক সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে সখাসংঘের জন্য ভোট চাওয়া— রাজনৈতিক কৌশলের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল শুনি? ব্যক্তিজীবন এবং সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র— খাদ্য, পরিবেশ, ক্রীড়া, সাহিত্যচর্চা, বিনোদন সবকিছুকেই যে গুরুত্ব দিতে হবে, পরিচালন করতে হবে সৃজনশীলতার সঙ্গে, সেই ভাবনা রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন ১৯১২ সালে। সেবা বিভাগের ভাবনাই কি আমাদের মতো পড়ুয়াদের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর চিন্তাশীল হওয়ার প্রথম সোপান নয়? গণতন্ত্রও ছিল— ছিল কেন্দ্রিকতাও। সাধারণ সভার টান টান তর্কবিতর্ক, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছি তাদের প্রশ্নের প্রতি দায়বদ্ধ হতে শিখিয়েছিল। গৃহীত কর্মসূচীর মূল্যায়ন ও আগামী কর্মসূচীর পরিকল্পনা করা— একটা সামগ্রিক শিক্ষা। এই শিক্ষা পায়ের তলার মাটির উপর দাঁড়াতে শেখায়। এই শিক্ষাই গড়ে তোলে জীবনবোধ। ছাত্ররা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না, অধ্যয়নই তাদের প্রধান কর্তব্য— এই নীতিকথা রবীন্দ্রনাথই আমার জীবনবোধে নস্যাৎ করেছিলেন। এ নিয়ে আমার সাথে বহু মানুষেরই মতপার্থক্য থাকবে জানি। তবু এ একান্ত আমার বেড়ে ওঠা। ‘ঐতিহ্যময়ী রবীন্দ্রপ্রেমী’ (পড়ুন রবীন্দ্র-আদর্শ বিরোধী) কি তখন ছিল না? আলবাত্ ছিল। এদের সাথে যুদ্ধু করার হাতিয়ারও ছড়ানো থাকত বইয়ের পাতায়, রবীন্দ্রনাথেই।
এই রবীন্দ্রনাথেই শরতের আকাশে মহালয়ার চেয়েও উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল আনন্দবাজারের, যেখানে হাতে হাতে যৌথতা শিখেছি। শিমুল ফুলে মারামারি, ‘রুদ্রপলাশের পিচিকিরির’ দাগে আর হলুদ গৌরপ্রাঙ্গনে বসন্তকে জেনেছি— হোলিকা দহনের ব্রাহ্মণ্যবাদী উৎসব হোলির কোনও স্থানই তো সেখানে নেই। আমাদের নববর্ষ ছিল মুখে মুখে ফেরা নৃত্যনাট্যের গানে। যে বছর যে নৃত্যনাট্য হত গোটা হস্টেলে শুধু তারই গান আর নাচ। নববর্ষে হাতে বানানো কার্ড, রাখীতে রাতভর রাখী বানানোর এমার্জেন্সি আমাদের উৎসবে— শাস্ত্রের পাঠের চাইতে বেশি লেগে থাকত নিজেদের হাতের ছোঁয়া।
আজ যদি মতাদর্শ হিসেবে মার্কসবাদকে ভিত্তি করে থাকি তবে রবীন্দ্রনাথই যে তার সূত্রপাত ছিল সেটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না। রক্ষণশীল ধার্মিক পারিবারিক চেতনা থেকে মুক্তমননের পথে রবীন্দ্রনাথই আমার প্রথম শিক্ষক ছিলেন। বুধবারের মন্দির আমাকে ব্রাহ্ম করতে চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়নি… বরং জটিল ধর্মচর্চার প্রভাব কাটিয়ে সকালের আলোর থেকে শিখতে বলেছিল মনে মনে। জাতপাতের গোঁড়া ধ্যানধারণায় পড়েছিল পঞ্চকের আঘাত। রাষ্ট্রনীতিই হোক বা শিক্ষানীতি, কঠোর শাসনতন্ত্র শাসয়িতার অযোগ্যতার প্রমাণ— এই কথাটা বলার জন্য আমাকে বামপন্থী হতে হয়নি। কিন্তু মার্কসবাদ এই কথাটাকে গভীরভাবে অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছে অবশ্যই।
এই তো কদিন আগে রবীন্দ্রজয়ন্তী গেল।।
এই তো সেদিনই ১৭ জন জলজ্যান্ত পরিযায়ী শ্রমিকের লাশ ছত্রাকার পড়েছিল রেললাইনে। তার আগে বিশাখাপত্তনমে বিষাক্ত গ্যাসে মারা গেছে মানুষ। তার পরে ট্রাকে চাপা পড়ে মারা গেছে একটা গোটা শ্রমিক পরিবার। আর কিছু খবর চাপা পড়ে যায়… রোজ-রোজ।
কোন বাস্তবটার জন্য আওয়াজ তুলব, গান গাইব, লিখব সেই পক্ষটা বেছে নিতে রবীন্দ্রনাথ কোনও দ্বিধা রাখেনি আমার মধ্যে। যদি গান গাইতেই হয় তাহলে এই অসম লড়াইয়ে হাতিয়ার করব রবীন্দ্রনাথের গানকেও। যেখানে ‘বাড়ি’র জন্য বেরিয়ে মারা যায় একের পর এক শ্রমিক; যেখানে লকআউটকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা হয় বেঁচেবর্তে থাকা গুটিকতক শ্রম আইনকে বাতিল করার স্বার্থে; যেখানে গুরুদেবের ভজনারত লোকজনের কিছু এসেও যায় না সেই শ্রমিকের লাশ দেখে— সেইখানেই আমি জোরগলায় বলতে পারি— পক্ষ নিতে প্রথম তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি।