যত অস্তাচলের দিকে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তত তাঁর কবিতার ভাষায় লেগেছে নিত্যদিনের সহজতা। শব্দ আর ধ্বনির ঝংকার হয়েছে বিরল। উচ্চকিত মিল মুখ লুকিয়েছে। আমাদের চারপাশের ছবি এসে বসেছে তাঁর পদাবলিতে। অস্তাচলে এসে মাঝেমাঝেই তাকিয়েছেন পূর্বাচলের পানে। ছেলেবেলার দিনগুলির কথা বলেছেন সহজ-সুরে। তাঁর জীবনের কথা সাজিয়ে একদিন লিখেছিলেন ‘জীবনস্মৃতি’, শেষবেলায় লিখলেন ‘ছেলেবেলা’। ‘জীবনস্মৃতি’তে কত কারুকার্য– আর ‘ছেলেবেলা’ সহজ ছবির অ্যালবাম। ‘জীবনস্মৃতি’ যেন উদ্যান আর ‘ছেলেবেলা’ যেন বাগান– ‘চায় নাই যশ/ উদ্যানের পদবীতে।’
কেন এমন করে সহজতার দিকে যাচ্ছিল তাঁর মন? অকারণে নয়। উপযোগবাদী ধনতন্ত্রের পুঁজি আর পুঁজ তখন চারিদিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢোল-ডগর উঠেছে বেজে। নেশনের জয়ধ্বজা ওড়ানোর জন্য কত বাহাদুরি। চাকচিক্যময় আর দর্শনীয় বস্তু-প্রপঞ্চে নাগরিকের মন দখলের লড়াই। এ কৌশলের কথা রবীন্দ্রনাথ তো লিখেছিলেন তাঁর নাটকে, অনেক আগেই। ‘মুক্তধারা’ (১৯২৩)-য় যন্ত্ররাজ বিভূতি যে বাঁধ দিলে তার বড়ত্ব দেখে প্রজারা হাঁ হয়ে যায়। বড়ো আর দর্শনীয় করে না তুলতে পারলে শক্তির প্রমাণ রাজ্য-রাষ্ট্র দেবে কেমন করে! রক্তকরবী (১৯২৪)-তেও যে সোনার খনি-শহরের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারও দেখনদারিত্ব আর নজরদারির শেষ নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দমননীতি হজম করে সেই ১৯২৩-১৯২৪-এ ‘মুক্তধারা’-‘রক্তকরবী’র সময় জার্মানিতে হিটলার ক্রমশ মাথা তুলছেন। খর্বাকৃতি এই স্বৈরাচারী বাক্বিভূতিতে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিলেন হতাশ জার্মানদের। পরিশুদ্ধ আর্যরক্তবাহী জার্মানির নামে রাষ্ট্রতান্ত্রিক একতার বোধ জাগিয়ে তোলার জন্য গড়ে তুলতে চাইছিলেন দর্শনীয় বস্তু, নাগরিকদের সম্ভাষণে বুনে দিতে চাইছিলেন রাষ্ট্রীয় প্রথা। স্পেক্টাকেল আর রিচুয়ালের দেখনাইতে জেগে উঠছিল কল্পিত জার্মান ঐক্য, বেজে উঠছিল ‘অক্ষম’ জিপসি-ইহুদিদের বলিদানের বাদ্য। তারই ফল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছিলেন এই দেখনদারিত্ব যে কেবল রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে উঠবে তাই নয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরও দখল করে নেবে। প্রতি-মুহূর্তে হয়তো প্রশ্ন করা হবে সাধারণ মানুষকে কী যোগ্যতায় কী মূল্যে সে বেঁচে থাকতে চায়? ডারউইন পশুজগতে যে যোগ্যতমের উদ্বর্তনের কথা বলেছিলেন সেই যোগ্যতমের উদ্বর্তনের কথাই তো হিটলারের জার্মানি বলেছিল। সামাজিক ডারউইনবাদের তপ্ত শলাকায় খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল অক্ষম-অযোগ্যদের। তাদের জন্য গ্যাসচেম্বার– এ জগৎ এক মহাহত্যাশালা।
অস্তাচলের পানে এসে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষা নিরালংকার। ছবি আঁকেন তিনি অক্ষম-অযোগ্য প্রকৃতি-পরিবেশের। যা কাজে লাগে না, যশ-খ্যাতি-পুঁজির নামে জয়ধ্বনি দেয় না এমন মানুষ আর প্রকৃতির কথা তাঁর পদাবলিতে জীবনের শেষবেলায় ফিরে ফিরে আসে। ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘স্কুল-পালানে’ কবিতার কথা মনে নেই? অনাদৃত এক বাগান, মালির হাতে সে উদ্যান হয়ে ওঠেনি। দক্ষিণে কুয়োর ধারে কুলগাছ, পুবদিকে নারিকেল সারে সারে। বাকি সব জঙ্গল আগাছা। সেই আগাছাকে কোনও হিটলারি মালি এসে সাফ করে দেয় না। কোকিল, দোয়েল টিয়ে সে বাগানে আসে না। আসে চড়ুই আর কাক। এই দুটি কাছের পাখির দিকে বড়ো মমতায় চেয়ে থাকেন কবিতার স্মৃতিময় কথক।
‘আরোগ্য’ কাব্যগ্রন্থের ২৪-নম্বর কবিতাটির কথা মনে পড়বে। ২৩ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে লেখা। কবির জীবন ফুরিয়ে আসছে। কটা আর মাস। নিজের শেষবেলার কবিতার রূপ-স্বরূপের কথা প্রকাশিত হয়েছিল তাতে। লিখেছিলেন, ‘অলস শয্যার পাশে জীবন মন্থরগতি চলে,/ রচে শিল্প শৈবালের দলে/ মর্যাদা নাইক তার, তবু তাহে রয়/ জীবনের স্বল্পমূল্য কিছু পরিচয়।’ এই যে স্বল্প নিয়ে থাকার জীবন এর মহিমা টের পাচ্ছেন নতুন করে। ছোটো কথার ছোটো ব্যথার যে জীবন তার কথা একরকম করে লিখেছিলেন অনুজ এক কবি। রূপসী বাংলায় জীবনানন্দ খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘চারি দিকে শান্ত বাতি – ভিজে গন্ধ – মৃদু কলরব;/ খেয়ানৌকাগুনো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;/ পৃথিবীর এই গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;/ এশিরিয়া ধুলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে।’
এই যে সাধারণের জীবন যা দর্শনীয় নয়, বৃহৎ নয় তাই তো মানবধারা। কংগ্রেসের নেতারা যখন রাজনীতির বড়ো-তালুকে বক্তৃতারত তখন রবীন্দ্রনাথ যেতে চেয়েছেন সাধারণের কাছে। কুবেরের সম্পদ কেবল জমে থাকে। সেই পুঞ্জীভূত সম্পদের প্রতাপ সাধারণ মানুষকে পোড়ায়। শ্রীমন্ত গ্রাম – সে তো লক্ষ্মীর ঘর-দুয়োর। সে গ্রামখানিই তো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কবি। রাজনীতির বড়ো দরবারের বাইরে এসে পল্লীপ্রকৃতির কাছে তাঁর আসন পাতা। হাত দিয়েছিলেন পল্লী-পুনর্গঠনের কাজে।
আজকাল রবীন্দ্রনাথের কাছে বসতে ইচ্ছে করে। না সবজান্তা নন তিনি। সব কিছু মিলবে না তাঁর ভাণ্ডারে। সব কিছুর সমাধানও দিতে পারেননি তিনি। দেওয়া সম্ভবও নয়। মনে হয় সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে স্পেকটাকেল আর রিচুয়াল তৈরিতে যেভাবে মত্ত হয়েছিল জার্মানি সেভাবেই যেন মত্ত হয়েছে দেশ। রাজনীতি সত্যের কাছে যেতে চায় না, সে দায়বদ্ধ ‘পোস্টট্রুথ’-এর কাছে। জনগণকে নিজেদের মতে মাতিয়ে তোলার জন্য কত-রকম অছিলা এখন এই দেশে। উড়ন্ত আকাশযান থেকে পুষ্পবৃষ্টি করে রাষ্ট্র। তাই দেখে হাঁ হয়ে যায় অতিমারি কবলিত দেশ। কুরুক্ষেত্রের আগে কৃষ্ণও তো অর্জুনের সামনে এমন ভয়ংকর দর্শনীয় বিশ্বরূপ নির্মাণ করেছিলেন। বিশাল সেই মূর্তির হাঁ-মুখে ঢুকে যাচ্ছিল সব। তাই দেখে অর্জুনের ক্লীবতা দূর হল, গাণ্ডীব ধরলেন তিনি ক্ষাত্র-তেজে। জনগণও রাজনীতির কারবারিদের সত্য-নির্মাণের পুতুল-খেলায় ভুলে যায় সব। আর তখনই আরও একবার বসতে ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথের শেষবেলার অলংকারহারা লেখাগুলির কাছে, মনের আরাম সেখানে– নিরাময় মেলে। শব্দের সেই সহজ রূপের কাছে বসে বলতে ইচ্ছে করে আমাদের জীবনের বাগানের আগাছা-কাক-চড়ুইগুলোকে মেরে ফেলে নাই বা হয়ে উঠলাম খ্যাতিময় উদ্যান।
আগাছার অধিকারই তো গণতন্ত্রের প্রকৃত অধিকার।